খাদ্যে পরিমাণমতো শর্করা, আমিষ এবং স্নেহ পদার্থ থাকার পরেও জীবের স্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং পুষ্টির জন্য বিশেষ এক ধরনের খাদ্য উপাদানের প্রয়োজন হয়। ঐ খাদ্য উপাদানকে ভিটামিন বলে।
ভিটামিন প্রাণীর স্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং শরীর সুস্থ রাখার জন্য অপরিহার্য। ভিটামিন হচ্ছে জৈব প্রকৃতির যৌগিক পদার্থ। আমরা যদি প্রতিদিন প্রচুর শাকসবজিসহ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাই তাহলে আমাদের দৈনন্দিন খাবার থেকেই প্রয়োজনীয় ভিটামিন পেয়ে যেতে পারি।
কয়েকটি ভিটামিন স্নেহজাতীয় পদার্থে দ্রবীভূত হয়, আবার কয়েকটি ভিটামিন পানিতে দ্রবীভূত হয়। যেমন:
স্নেহে দ্রবণীয় ভিটামিন: ভিটামিন A, ভিটামিন D, ভিটামিন E ও ভিটামিন K।
পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন: ভিটামিন B কমপ্লেক্স এবং ভিটামিন C
স্নেহে দ্রবণীয় ভিটামিন
ভিটামিন A
প্রাণিজ উৎসের মধ্যে ডিম, গরুর দুধ, মাখন, ছানা, দই, ঘি, যকৃৎ ও বিভিন্ন তেলসমৃদ্ধ মাছে, বিশেষ করে কড মাছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন A পাওয়া যায়। উদ্ভিজ্জ উৎসের মধ্যে ক্যারোটিন সমৃদ্ধ শাক- সবজি, যেমন- লালশাক, কচুশাক, পুঁইশাক, পাটশাক, কলমিশাক, ডাঁটাশাক, পুদিনা পাতা, গাজর, মিষ্টি কুমড়া, ঢেঁড়স, বাঁধাকপি, মটরশুঁটি এবং বিভিন্ন ধরনের ফল যেমন: আম, পাকা পেঁপে, কাঁঠাল ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন A রয়েছে।
কাজ : ভিটামিন A যেসব কাজ করে সেগুলো হলো :
১. দেহের স্বাভাবিক গঠন এবং বর্ধন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার কাজ নিশ্চিত করে।
২. দেহের বিভিন্ন আবরণী কলা যেমন: ত্বক, চোখের কর্নিয়া ইত্যাদিকে স্বাভাবিক ও সজীব রাখে।
৩. হাড় এবং দাঁতের গঠন এবং দাঁতের মাড়ি সুস্থ রাখে।
৪. দৃষ্টিশক্তি ঠিক রাখে এবং রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে।
৫. দেহে রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধ করে।
অভাবজনিত রোগ ও প্রতিকার : ভিটামিন A এর অভাবে রাতকানা রোগ হয়। এর অভাব দীর্ঘস্থায়ী হলে চোখের কর্নিয়ায় আলসার হতে পারে— এ অবস্থাকে জেরপথ্যালমিয়া রোগ বলে। এই রোগ হলে আক্রান্ত মানুষ পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যেতে পারে। ভিটামিন A এর অভাবে দেহের বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয় । অনেক সময় ঘা, সর্দি, কাশি, গলাব্যথা ইত্যাদি উপসর্গও দেখা দেয়। ভিটামিন A এর অভাবে ত্বকের লোমকূপের গোড়ায় ছোট ছোট গুটির সৃষ্টি হতে পারে।
ভিটামিন D
একমাত্র প্রাণিজ উৎস থেকেই ভিটামিন D পাওয়া যায়। এই ভিটামিন সূর্যালোকের অতিবেগুনি রশ্মির সাহায্যে মানুষের ত্বকে সংশ্লেষিত হয়। ডিমের কুসুম, দুধ এবং মাখন ভিটামিন D— এর প্রধান উৎস। বাঁধাকপি, যকৃৎ এবং তেলসমৃদ্ধ মাছে ভিটামিন D পাওয়া যায়।
ভিটামিন D শরীরে ক্যালসিয়াম শোষণ করতে সাহায্য করে, যা হাড় তৈরির কাজে লাগে। ভিটামিন D— এর অভাবে শিশুদের রিকেট রোগ হতে পারে। দৈনিক চাহিদা থেকে বেশি পরিমাণে ভিটামিন D গ্রহণ করলে শরীরের ক্ষতি হয়। এর ফলে অধিক ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস শোষিত হওয়ায় রক্তে এদের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। যে কারণে বৃক্ক (কিডনি), হৃৎপিণ্ড, ধমনি ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম জমা হতে থাকে ।
ভিটামিন E
সব রকম উদ্ভিজ্জ ভোজ্য তেল বিশেষ করে পাম তেল ভিটামিন E— এর ভালো উৎস। প্রায় সব খাবারেই কমবেশি ভিটামিন E আছে। তাছাড়া শস্যদানার তেল (Corn oil), তুলা বীজের তেল, সূর্যমুখী বীজের তেল, লেটুস পাতা ইত্যাদিতে ভিটামিন E পাওয়া যায়। মানুষের শরীরে ভিটামিন E হলো এন্টি- অক্সিডেন্ট, যেটি ধমনিতে চর্বি জমা রোধ করে এবং সুস্থ ত্বক বজায় রাখে। এ ছাড়া ভিটামিন E কোষ গঠনে সাহায্য করে এবং মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর বন্ধ্যাত্ব দূর করে। ভিটামিন E— এর অভাবে জরায়ুর মধ্যে ভ্রূণের মৃত্যুও হতে পারে। দৈনিক সুষম খাদ্য গ্রহণ করলে এই ভিটামিনের বিশেষ অভাব হয় না।
ভিটামিন B কমপ্লেক্স
পানিতে দ্রবণীয় ১২টি ভিটামিন B রয়েছে। ভিটামিনের এই গুচ্ছকে ভিটামিন B কমপ্লেক্স বলা হয়। দেহের স্বাভাবিক সুস্থতার জন্য খাবারে ভিটামিন B কমপ্লেক্স খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেহের বৃদ্ধি, স্নায়ু ও মস্তিষ্কের কাজ, দেহকোষে বিপাকীয় কাজ, প্রজনন ইত্যাদি সম্পন্ন করার জন্য খাদ্যে ভিটামিন B কমপ্লেক্সের উপস্থিতি অতি আবশ্যক।
ভিটামিন B কমপ্লেক্সভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিনগুলোর উৎস এবং অভাবজনিত রোগ নিচের টেবিলে দেওয়া হলো:
ভিটামিন | উৎস | অভাবজনিত রোগ |
থায়ামিন (B1 ) |
ঢেঁকিছাঁটা চাল, আটা, ডাল, তেলবীজ, বাদাম, যকৃৎ, টাটকা ফল ও সবজি। প্রাণিজ উৎসের মাঝে রয়েছে যকৃত, ডিম, দুধ, মাছ ইত্যাদি। |
দেহে থায়ামিনের চরম অভাবে বেরিবেরি রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। এর অভাবে | স্নায়ুর দুর্বলতা, মানসিক অবসাদ, ক্লান্তি, খাওয়ায় অরুচি, ওজনহীনতা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। |
রাইবোফ্ল্যাভিন (B2 ) |
যকৃৎ, দুধ, ডিম, সবুজ শাক- | সবজি, গাছের কচি ডগা, অঙ্কুরিত বীজ। |
এর অভাবে ঠোঁটের দুপাশে ফাটল দেখা দেয়, মুখে ও জিভে ঘা হয়, ত্বক খসখসে হয়। চোখ দিয়ে পানি পড়ে। এর অভাবে | তীব্র আলোতে চোখ খুলতে অসুবিধা হয়। এর অভাবে পেলেগ্রা রোগ হয়। পেলেগ্রা | রোগে ত্বকে রঞ্জক পদার্থ জমতে শুরু হয় এবং সূর্যের আলোয় দ্রুত বৃদ্ধি পায়। | ফলে ত্বকে লালচে দাগ পড়ে এবং ত্বক খস খসে হয়ে যায়। এছাড়া জিভে রঞ্জক পদার্থ জমে জিভের এট্রোফি হয়। |
নিয়াসিন বা নিকোটিনিক এসিড (B5) | মাংস, যকৃৎ, আটা, ডাল, বাদাম, তেলবীজ, ছোলা, শাক- সবজি। | এর অভাবে পেলেগ্রা রোগ হয়। পেলেগ্রা | রোগে ত্বকে রঞ্জক পদার্থ জমতে শুরু হয় এবং সূর্যের আলোয় দ্রুত বৃদ্ধি পায়। | ফলে ত্বকে লালচে দাগ পড়ে এবং ত্বক খস খসে হয়ে যায়। এছাড়া জিভে রঞ্জক পদার্থ জমে জিভের এট্রোফি হয়। |
পিরিডক্সিন (B6) |
চাল, আটা, মাছ, মাংস, শাক- সবজি, ছোলা, ছত্রাক, বৃক্ক, ডিমের কুসুম। |
এর অভাবে খাওয়ায় অরুচি, বমিভাব ও অ্যানিমিয়া রোগ দেখা দেয়। |
কোবালামিন বা | সায়ানোকোবালামিন (B12) | যকৃৎ, দুধ, মাছ, মাংস, ডিম, পনির, বৃক্ক প্রভৃতি। | এর অভাবে রক্তশূন্যতা রোগ দেখা দেয় । স্নায়ুতন্ত্রের অবক্ষয় ঘটে। |
ভিটামিন C (অ্যাসকরবিক এসিড)
টাটকা শাক-সবজি এবং টাটকা ফলে ভিটামিন C পাওয়া যায়। শাক-সবজির মধ্যে মুলাশাক, লেটুস পাতা, ধনে পাতা, পুদিনা পাতা, কাঁচা মরিচ, ফুলকপি, করলা ইত্যাদিতে ভিটামিন C আছে। ফলের মধ্যে আমলকী, লেবু, কমলালেবু, টমেটো, আনারস, পেয়ারা ইত্যাদি ভিটামিন C — এর উৎস। শুকনো ফল ও বীজে এবং টিনজাত খাদ্যে এই ভিটামিন থাকে না।
ভিটামিন C শরীরে যেসব কাজ করে সেগুলো হলো:
১. ত্বক, হাড়, দাঁত ইত্যাদির কোষসমূহকে পরস্পরের সাথে জোড়া লাগিয়ে মজবুত পাঁধুনি তৈরি করে।
২. শরীরের ক্ষত পুনর্গঠনের কাজে সাহায্য করে।
৩. দাঁত ও মাড়ি শক্ত রাখে।
৪. স্নেহ, আমিষ ও অ্যামাইনো এসিডের বিপাকীয় কাজে ভিটামিন C গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৫. ত্বক মসৃণ এবং উজ্জ্বল রাখে।
৬. রোগ প্রতিরোধ করে।
ভিটামিন C এর তীব্র অভাবে স্কার্ভি দাঁতের মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়া) রোগ হয়। এর অভাবে (ক) অস্থির পঠন শক্ত ও মজবুত হতে পারে না। (খ) ত্বকে যা হয়, ক্ষত শুকাতে দেরি হয়। (গ) দাঁতের মাড়ি ফুলে দাঁতের ইনামেল উঠে যায়। দাঁত দুর্বল হয়ে অকালে ঝরে পড়ে। (খ) রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা কমে গিয়ে সহজে ঠাণ্ডা লাগে।
কাজ: আমরা যে ভিটামিনগুলো নিয়ে আলোচনা করলাম, দেহে সেগুলোর অভাব হলে কী কী রোগ দেখা দিতে পারে তার একটা চার্ট প্রস্তুত কর। |
আরও দেখুন...